নূতন মাত্রায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট
০৭ নভেম্বর, ২০২১, 3:18 PM

NL24 News
০৭ নভেম্বর, ২০২১, 3:18 PM

নূতন মাত্রায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট
লে: কর্নেল মোঃ রুহুল আমীন (অবঃ)
গত বেশ কয়েক বছর থেকেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য (সাবেক আরাকান) থেকে বিতাড়িত ও নির্যাতিত হয়ে ১১ লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের নিজেরই সমস্যার অন্ত নেই, তার উপর লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বোঝা নূতন করে সংকট সৃষ্টি করেছে। কক্সবাজারÑটেকনাফে ৩৪টি শরণার্থী ক্যাম্পে আধুনিক সুবিধা বঞ্চিত ও আর্থিকভাবে নিঃস্ব এই শরণার্থীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাংলাদেশ সরকার ও দেশীÑবিদেশী এনজিও বা সাহায্য সংস্থা তাদের ন্যূনতম চাহিদা মিটাতে সাহায্য করছে। সরকার আইন শৃংখলা বাহিনী নিয়োগ করে তাদের নিরাপত্তা প্রদান ও শান্তিÑশৃংখলা রক্ষার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। বেকার ও অভাবগ্রস্ত যুবকরা জড়িয়ে পড়েছে মাদকদ্রব্য পাচার সহ বিভিন্ন অপরাধে । তারা নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। চুরি, রাহাজানি, ধর্ষণ, খুন, ডাকাতি, হাইজাকিং ইত্যাদিতেও তারা জড়িত। এসবের প্রভাব স্থানীয় জনগনের উপরও পড়ছে। ওদিকে স্থানীয়দের সাথে তাদের সুসম্পর্ক নেই যদিও রোহিঙ্গাদেরকে স্থানীয়রা প্রথমদিকে সহানুভুতি ও মানবিক দৃষ্টিভংগী দিয়ে গ্রহণ করেছিল। এখন তারাই এদের নিয়ে সমস্যায় জর্জরিত। তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে। বনÑবাদাড় উজাড় হচ্ছে, পাহাড় ধ্বংশ হচ্ছে, পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটানোর প্রয়োজনে। এখন স্থানীয়রাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। রোহিঙ্গারা নিজেরাও অনিরাপদ। রাতে পাহাড়ী ক্যাম্পগুলোতে সুনসান অন্ধকার। বিভিন্ন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ চাঁদা আদায় ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করছে তাদের উপর। সর্বশেষ গত ২১ অক্টোবর সশ¯্র রোহিঙ্গা গ্রুপ রোহিঙ্গাদের একটি মাদ্রাসায় ৬ জন শিক্ষক ও ছাত্রকে হত্যা করে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গাদের আন্ত-দলীয় কোন্দল ও অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলছে। এটি বাংলাদেশের বড় মাথাব্যথা। এই সমস্যাগুলোতে নূতন মাত্রা যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি শরণার্থীদের অবিসংবদিত নেতা মুহিবুল্লার হত্যাকান্ডে। গত ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০২১ রাতে আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইট্স্Ñএর চেয়ারম্যান মুহিবুল্লাহকে উখিয়ার কুতুপালংয়ের লম্বাশিয়া আশ্রয় শিবিরে নিজ অফিসে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে শরণার্থীদের সংগঠিত করেন। তাদের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য তিনি দেশেÑবিদেশে কাজ করেছেন। বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান ও নেতাদের সাথে বৈঠক করেছেন। ২০১৯ সালের ২৫শে আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং শিবিরের ফুটবল মাঠে মিয়ানমারের গনহত্যা বিরোধী মহাসমাবেশে কয়েক লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটান তিনি। তিনি ঐ দিনটিকে ‘গনহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথেও তিনি কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে তিনি সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। তাঁর এই জনপ্রিয়তা ও প্রভাবে তার প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ ঈর্ষান্বিত হয় এবং বিরোধিতা করে। তারা প্রত্যাবাসনের বিরোধী। তারাই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে ধারনা। মুহিবুল্লাহ্র ভাই ও স্ত্রী এভাবেই মত প্রকাশ করেছেন এবং মামলা দায়ের করেছেন। অভিজ্ঞমহল ও বিভিন্ন নেতৃবৃন্দও একই ধারণা পোষন করেন। যারা এই কাজটি করেছে তারাও রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিবদমান গ্রুপ ও কোন্দল রয়েছে। এছাড়া মিয়ানমারের গোয়েন্দারা রোহিঙ্গাদের সাথে মিশে তথ্য সংগ্রহ ও পাচার করছে। মিয়ানমার চায় না প্রত্যাবাসন আন্দোলন জোরদার হোক। গুপ্তচররাই গ্রুপিং ও কোন্দলে উসকানী দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। সর্বশেষ এবং গুরত্বপূর্ণ তথ্য হল, মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্ঠী আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি) জড়িত। মুহিবুল্লাহ্র ছোটভাই হাবিবুল্লাহ্ এই হত্যাকান্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি হত্যাকান্ডে অংশগ্রহণকারী একজন আরসা নেতা সহ তিনজনের নামও বলেছেন। এই হত্যাকান্ড সরকারের জন্য বিব্রতকর এবং অতিরিক্ত চাপ। বাংলাদেশ সরকার এই হত্যাকান্ড তদন্তে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে। রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আইন শৃংখলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো হচ্ছে। ইতোমধ্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৫ ও ৭৬তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জোর বক্তব্য রাখেন। ওদিকে মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডে পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সুষ্ট তদন্ত ও বিচার দাবী করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই সংগে যোগ দিয়েছে। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ড্স্ ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতগণ, জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার (ইউ এন এফ সি আর), অ্যামনেস্টি ইনটারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ও তাদের প্রত্যাবাসনে যারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে তারা কেউ মুখ খোলেনি। মায়ানমারের নিকট প্রতিবেশীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন। তাদের ব্যবসায়িক, অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তারা রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখছে না। অথচ তারাই মূল খেলোয়াড়। রাশিয়া ও চীন জাতিসংঘে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা বিষয়ে মায়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। একই কারণে ভারতও তাদের দলে যোগ দিয়েছে। ফলে কোন উদ্যোগই কার্যকর হচ্ছে না। অথচ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে নিজ বাস্তুভিটায় প্রত্যবাসনই একমাত্র সমাধান। কিন্তু তা সুদূর পরাহত। মূলত : রোহিঙ্গারা বিশ্বের সবচেয়ে অবহেলিত ও কম গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। তাদের কোন অভিভাবক নেই। বাংলাদেশের পক্ষে শুধু নিজ প্রচেষ্টায় তাদের জন্য কোন ত্বরিৎ ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গাদের সবচেয়ে নিকট ও নৃতাত্বিক প্রতিবেশী বাংলাদেশ। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হলে তাদের জন্য আশ্রয় বাংলাদেশেই। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকার ও জনগণ ‘বাঙ্গালী’ বলে অভিহিত করে সে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। তাদের অন্যতম দুর্ভাগ্য যে তারা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমান। কক্সবাজারÑটেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো অপরাধীদের অভয়ারণ্য। খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, দলাদলি, মানবপাচার ইত্যাদির সংগে নিত্য জড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। মহিবুল্লাহ হত্যার আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ১০৮টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে (বাংলাদেশ পিস অব জারভেটরি বা বিপিওÑএর রিপোর্ট)। দিনদিন খুনÑরাহাজানি সহ অপরাধ বাড়ছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর চেষ্টা সত্ত্বেও অপরাধ শিবিরে অন্যুন ১৪টি রাজনৈতিক ও মাদক পাচারকারীদের সন্ত্রাসী গ্রুপ রয়েছে। যারা নিজেদের মধ্যেও অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত। মুহিবুল্লাহ হত্যার অন্যতম কারণ এই দ্বন্দ্ব। এই গ্রুপগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি), আর এস ও (রোহিঙ্গা সলিভারিটি অর্গানাইজেশন), ইসলামী মাহাস ও জমিয়তুল মোজাহেদিন। আধিপত্য বিস্তার ও ধনী হওয়ার জন্য এসব গ্রুপ রাহাজানিতে লিপ্ত এবং মাদক পাচারে নেতৃত্ব দেয়। শিবিরগুলোতে অর্ধশত মাদক কারবারের গডফাদার রয়েছে বলে রিপোর্ট আছে। রোহিঙ্গা শিবিরের পরিবেশকে অস্থির করার জন্য মিয়ানমার থেকে অস্ত্র আসছে বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে জানিয়েছেন সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে। ওদিকে মুহিবুল্লাহ্ হত্যাকান্ডে বিদেশী সংস্থার জড়িত থাকার কথাও সন্দেহ করছে সংবাদ মাধ্যম। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ঠেকাতে মিয়ানমার গোয়েন্দাগিরি অব্যাহত রেখেছে এবং তাদের এজেন্ট আন্ত:কোন্দল ও অপরাধে উস্কানি দিচ্ছে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর সরকার নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে, প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া যত দেরী হবে ততই অপরাধের মাত্রা বাড়ছে এবং বাড়বে। কিছু দেশীÑবিদেশী বেসরকারী সংস্থা (এনজিও) এই হত্যাকান্ডে ইন্ধন যোগাতে পারে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কিছু এনজিও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে, আবার কিছু আগ্রহ দেখাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী নিজে এবিষয়ে মত প্রকাশ করেছেন। এর পেছনে তাদের নিজেদের এবং ভুরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে আতংক ও থমথমে ভাব। মুহিবুল্লাহর পরিবারসহ অনেক রোহিঙ্গা নেতা ইউ এন এইচসি আর Ñএর কাছে অন্য কোন দেশে আশ্রয়ের আবেদন করেছে। এমনকি দাতা সংস্থা কর্মীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। ইত্যেমধ্যে কিছু রোহিঙ্গা নেতাদের ইউএনএইচসি আর নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট বোঝা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আশ্রয়শিবির বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির এবং একসংগে এত শরণার্থী পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাংলাদেরশের মত একটি কম আয়তনের ও বেশী ঘনবসতির দেশের পক্ষে এই বোঝা বহন করা কঠিন। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনের উপর এটি অতিরিক্ত চাপ। বাংলাদেশ প্রতিমাসে ব্যয় করেছে তিনশত মিলিয়ন মার্কিন ডলার যা বাংলাদেশী টাকার আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশী। এছাড়া, দাতা গোষ্ঠী, জাতিসংঘের সংস্থা এবং এনজিওগুলো শরণার্থীদের আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য করছে। এরপরও বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছে গত চার বছরে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়াও, প্রশাসনিক এবং নারীÑপুরুষ ও শিশুদের জনস্বাস্থ্য শিক্ষা বিষয়ক সহায়তা দিচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে কক্সবাজারÑটেকনাফ থেকে শরণার্থীদের চাপ কমানো এবং আরো উন্নত জীবন যাপনের জন্য নোয়াখালীর ভাসানচরে এক লক্ষ শরণার্থীকে অস্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এপর্যন্ত সেখানে প্রায় ২০ হাজার শরণার্থীকে পাঠানো হয়েছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে এবং জনমানবশূণ্য ভাসানচরে যেতে রোহিঙ্গারা আগ্রহী ছিল না, এমনকি ইউএনএইচসিআরও (জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনারÑটঘঐঈজ) বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশংকায় বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে ইউএনএইচসিআর নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে এবং ভাসান চরকে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।এটি এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল এবং ইউইনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি সাক্ষর করে। জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সেখানে মাানবিক সহায়তা দেবে এবং বাংলাদেশ সরকার শরণার্থীদের, কর্মরত জাতিসংঘ ও এর সহযোগী সংস্থা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তা বিধান করবে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরো ৮০ হাজার শরণার্থীকে সেখানে স্থানান্তর করা হবে। ১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসানচরে ১৪৪০টি আশ্রয়গৃহ ও ১২০ টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে ইতোমধ্যে ৩৪টি এনজিও কাজ করছে এবং আশ্রয়প্রার্থীরা খাবার ও অন্যান্য সাহায্য পাচ্ছে। বাংলাদেশ তার ১৬ কোটি জনগণ নিয়ে এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত। মাত্র ১,৪৮,৪৬০ বর্গকিলোমিটার (৫৭,৩২০ব: মা:) আয়তনে এই জনসংখ্যা বিপুল এবং ঘনত্বের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী। তার উপর ১১ লক্ষ শরণার্থী মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী আগে থেকেই বাংলাদেশের কক্সবাজারÑটেকনাফ এলাকা তথা চট্টগ্রামে মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক তাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয়। তাতেই দেশ ও জনগনের উপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা বর্মী সেনাবাহিনী এবং ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী বৌদ্ধগোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়িত হয়ে বাংলাদেশÑমায়ানমার সীমান্তে আশ্রয় নেয়। নিতান্ত মানবিক কারনে তাদেরকে উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশ আশ্রয় দেয়। কিন্তু তাদের নিয়ে আইনশৃংখলা বাহিনী ও স্থানীয়রা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নানা অপকর্ম ও অপরাধ জড়িয়ে পড়ে খুন, রাহাজানি ও মাদক পাচারে লিপ্ত হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সংকটে পড়ে। মুহিবুল্লাহ্ হত্যাকান্ড এই সংকটে নূতন মাত্রা যোগ করে। রোহিঙ্গাদের এই আচরণ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করে এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিঘিœত হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য দীর্ঘ আলোচনা ও কুটনৈতিক তৎপরতার পর ২০১৮ সালে প্রথম ধাপে শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের তারিখ ঠিক হয়েছিল। মিয়ানমারের অনিহার কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট থেকে নূতন করে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা, তাও হয়নি। অবশ্য রোহিঙ্গারাও তাদের ন্যার্য দাবী পূরণ না হলে অর্থাৎ নাগরিক অধিকার না দিয়ে শুধু আশ্রয় শিবিরে থাকতে রাজী হয়নি। এরপরও কুটনৈতিক তৎপরতা চলতে থাকে। কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যগণ বিশেষ করে স্থায়ী সদস্যগণ (ইরম ঋরাব) একমত না হওয়ায় তা বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে ভূরাজনৈতিক চালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাকে প্রত্যাবাসনে রাজী করা যায়নি। জাতিগত নিধনের শিকার বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গারা আশ্রিত হিসেবেই বাংলাদেশে থাকছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটের একমাত্র সমাধান নাগরিক অধিকার নিয়ে নিজ বাস্তু ভিটায় প্রত্যাবাসন। তা যত দেরী হবে ততই সংকট বাড়বে এবং একসময় তা আঞ্চলিক সমস্যায় রূপ নিতে পারে। শরনার্থী জীবনের নির্যাতন ও দু:খ গাঁথা নিজের লেখা সাহিত্যকর্মে সকরুণভাবে এবং আপোষহীনভাবে তুলে ধরার জন্য ২০২১ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন তানজানিয়ার জাঞ্জিবার বংশোদ্ভুত যুুক্তরাজ্য প্রবাসী অধ্যাপকÑসাহিত্যক আবদুলরাজাক গুনহার। হয়তো তাঁর থেকে অনেক জাঁদরেল লেখকÑসাহিত্যিক ছিলেন সারা পৃথিবীতে। কিন্তু তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য বিষয়বস্তু তাঁকে এই পুরস্কারে ভুষিত করেছে। তা হল শরণার্থী জীবনের বিড়ম্বনা ও দুর্দশা। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও তাই। কিভাবে তাদের এই দুর্দশার মোচন হবে সেই প্রচেষ্টায়ই নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। কিন্তু তাতে বাধ সাধল স্বার্থানেষী মহল যারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন চায়নি। এখনেই নূতন মোড় নিয়েছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধানে। আর মিয়ানমারের সামরিক সরকার তা হতে দেয়নি এবং দেয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবে একটি আশার আলো ক্ষীণ হলেও দৃশ্যমান হচ্ছে। মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকার কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত ও কারাবন্দী অং সান সুচি ও তার দল এন এল ডি (ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি) সমর্থনে গঠিত প্রবাসী সরকার এনইউজি (National Unity Government) রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের আশ^াস দিয়ে তাদের সাথে যোগাযোগ হত। মিয়ানমারের জনগনের সমর্থনে এনইউজি আন্দোলন করছে এবং সরকার বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলো এনইউজিÑর সহযোগে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে সশস্ত্র গ্রুপ তৈরী করে ইউএনজিÑর সমর্থনে কাজ করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে বলে রিপোর্ট আসছে। তাই হয়তো মুহিবুল্লাহ্র পথে নূতন নেতৃত্ব সে লক্ষে কাজ করবে। বৈশি^ক শক্তির সহযোগিতা, কুটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং রোহিঙ্গাদের নিজস্ব তৎপরতা হয়তো একটা নূতন আশার সঞ্চার করবে। আবদুলরাজাকের নোবেল বিজয় এবং তার লেখায় বিশ^বাসীর কাছে শরণার্থীদের দু:খগাঁথা চিত্রে সহানুভূতি সৃষ্টি হোক এই আশা পোষণ করছি।
-অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক